টেকনাফের ঐতিহাসিক মাথিনের কুপের ইতিহাস | তারেক কক্স


বাংলাদেশের

সর্ব দক্ষিণে

অবস্থিত

টেকনাফ। নাফ

নদীর কোলঘেঁষে

গড়ে ওঠা এ

উপজেলায়

অবস্থিত

ঐতিহাসিক

মাথিনের কূপ। রাখাইন

জমিদার কন্যা মাথিন তার

নিজের জীবন বিসর্জন

দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন

প্রেমের মূল্য কত! আজ

হাজারো প্রেমের কাছে

মাথিনের প্রেম কাহিনী

ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।

এ নির্মোহ প্রেমের স্মৃতি

টেকনাফ থানা

কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরে

মাথিনের কূপ আজো

বহমান। প্রতিদিন এই কূপ

দেখার জন্য সেখানে বহু

পর্যটক ভিড় জমান। চিরসত্য

এ প্রেমের কাহিনী

লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ,

ইউসুফ-জুলেখা ও চণ্ডিদাস-

রজকিনীর প্রেমের

কাহিনীর চেয়ে কম নয়।

বিংশ শতকের প্রথমদিকে

টেকনাফ ছিল একটি ছোট্ট

বাণিজ্যিক এলাকা।

ব্যবসায়ীরা দেশের

বিভিন্ন প্রান্ত থেকে

চাল, কাঠ, তামাক, মাছ

এবং শুঁটকি এখানে জড়ো

করত। বার্মা থেকেও

অবাধে অবৈধ পথে এখানে

চাল আসত। এখানে

আদিবাসী রাখাইন

সম্প্রদায়ের লোকজনই

বেশি বসবাস করেন।

তখন দস্যুতা মাত্রাতিরিক্ত

বৃদ্ধির কারণে এবং

ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার

জন্য তৎকালীন সরকার

টেকনাফে একটি পুলিশ

ফাঁড়ি স্থাপন করে। যার

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

হিসেবে ধীরাজ

ভট্টাচার্য্য নামে এক

কর্মকর্তাকে কলকাতা

থেকে টেকনাফে আনা হয়।

দুর্গম টেকনাফে আসা

ধীরাজের জন্য রীতিমতো

অসম্ভব ছিল। তিনি

শিলাইদহ থেকে

গোয়ালন্দে ট্রেনে, তারপর

গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর

হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত

স্টিমারে; সেখান থেকে

স্টিম ইঞ্জিন ও ট্রেনে

চেপে চট্টগ্রামের বা'টালী

স্টেশনে আসেন।

সবুজ পাহাড়ে ঘেরা

টেকনাফ থানার অদূরে

সমুদ্রের নীল জলরাশি।

থানায় ধীরাজ

ভট্টাচার্য্যের তেমন কাজ-

কর্ম ছিল না। অনেকটা

এখানে-সেখানে ঘুরে

ফিরেই কাটাতেন।

থাকতেন থানার

আধাপাকা ঘরের একটি

কক্ষে।

তখন শীতকাল, সাগর ছিল

শান্ত। ওই বছর সাগরে প্রচুর

মাছ ধরা পড়ায় জেলেরাও

অতিরিক্ত সময় কাজ করে।

কলকাতা ছেড়ে

ভট্টাচার্য্য মহাশয় এই প্রথম

দুর্গম অঞ্চলে বাস করছেন।

তার প্রায়শ বাড়ির কথা

মনে পড়ে। কারণ তার ঘরে

ছিল বৃদ্ধ বাবা-মা।

ওই সময় টেকনাফে সুপেয়

পানির খুব অভাব ছিল।

একদিন থানার ছোট্ট

বারান্দায় এসে দেখেন রঙ

বেরংয়ের ফতুয়া (থামি-

ব্লাউস) পরিহিতা ৫০/৬০ মগ

তরুণী থানার সম্মুখে একটি

কুয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে

হাসিগল্পে মশগুল। এটিই

ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি

মাত্র কুয়া। প্রতিদিন

তরুণীরা কুয়ায় পানি নিতে

আসত। কেউ কেউ থানার

ছোট্ট বাগানের শিউলী

ফুল তুলত। ধীরাজ বাবু

প্রতিদিন গরম চা হাতে

থানার বারান্দার চেয়ারে

বসে তরুণীদের পানি

তোলার দৃশ্য দেখতেন।

একদিন তার নজরে পড়ে

সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত

এক তরুণী। সুন্দর এই তরুণীর

নাক-চোখ, মুখ বাঙালি

মেয়েদের মতো। নাম তার

মাথিন। টেকনাফের

জমিদার ওয়ান থিনের

একমাত্র মেয়ে। প্রথম

দর্শনেই মেয়েটিকে তার

ভালো লেগে যায়। তারপর

থেকে প্রতিদিন ভোর

হওয়ার হতেই তিনি

বারান্দার গিয়ে চেয়ারে

বসে মাথিনের আগমনের

প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন

যখন কলসি কাঁখে তার

সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা

প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে

আসতেন তখন ধীরাজ বাবু

তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ

করতেন। অন্য তরুণীরা

আসার আগেই মাথিন কুয়ায়

আসতেন এবং জল নিয়ে

ঘরে ফিরতেন। ভোরের

স্নিগ্ধ আলো আভায় নীরব

নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা

একে অপরের সঙ্গে গভীর

প্রেমে ও মোহাবেশে

আচ্ছন্ন থাকতেন। পরস্পরের

দিকে চেয়ে সম্ভব-অসম্ভব

নানা কল্পনার রঙিন জাল

বুনতেন। দেখা-দেখি,

হাসা-হাসি এভাবে তাদের

প্রেম ঘনীভূত হয়। দিন

গড়াতে থাকে। একদিন,

দুদিন এভাবে... এরই মধ্যে

দু'জনের প্রেমের কথা সবাই

জেনে যায়। নানা বাধা

সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে

বিয়ের কথা পাকাপাকি

হয়। এর মধ্যে কলকাতা

থেকে চিঠি আসে

ধীরাজের কাছে। তার

বাবা অসুস্থ, ধীরাজকে

কলকাতা যেতে হবে

একমাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি

না মিললে চাকরিতে

ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে

হবে। ধীরাজের আরো

একটি ইচ্ছা ছিল বিয়ের

আগে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে

তার বাবা-মাকে

জানানো। ধীরাজ

সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা

যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা

মাথিনকে জানানো হলো।

মাথিন রাজি হলেন না।

মাথিন নিশ্চিত ছিলেন না,

'পরদেশী বাবু' তাকে বিয়ে

করার জন্য কলকাতা থেকে

ফিরে আসবে কিনা?

অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ

এক সন্ধ্যায় টেকনাফ

ছেড়ে পালিয়ে যান।

মাথিনের মনে হলো, বাবার

অসুখের কারণে হয়তো

ধীরাজ কলকাতা চলে

গেছেন। কিন্তু বস্তুত

ধীরাজ মাথিনকে বিয়ে

করতে চাননি বলেই রাতের

অন্ধকারে কাপুরুষের মতো

টেকনাফ থেকে পালিয়ে

গেলেন।

ধীরাজের এভাবে চলে

যাওয়াকে প্রেমিকা

মাথিন সহজভাবে মেনে

নিতে পারেননি। প্রাণ-পুরুষ

ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন

নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে

শয্যাশায়ী হন। জমিদার

বাবা ওয়াথিনসহ

পরিবারের সদস্যরা শত

চেষ্টা করেও তার মুখে

দানা-পানি ছোঁয়াতে

পারেননি। তার এক কথা_

ধীরাজকে চাই।

 প্রেমের

এই বিচ্ছেদ অবশেষে প্রবল

কষ্টে একদিন মাথিন মারা

যান। এ কারণে প্রেমের

সাক্ষী 'মাথিনের কূপ'

দেখে এখনো হাজারো

প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের

ঐতিহাসিক প্রেমের কথা

স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত

হয়। ২০০৬ সালে ধীরাজ-

মাথিনের ইতিহাসের প্রায়

৮০ বছর পর টেকনাফ থানার

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

খালেদা হোসেন

সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস

রানাকে সঙ্গে নিয়ে

কূপটির সংস্কার করে

এটিকে দর্শনীয় স্থান

হিসেবে পরিচিতি দেন।

আজও অমর হয়ে আছে

মাথিনের কুপ।

ধীরাজ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত বই “যখন পুলিশ ছিলাম” 

ডাউনলোড লিংক “যখন পুলিশ ছিলাম.pdf”   

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form