বই পড়া ভারি মজা-
বুক রিভিউ
বই: বাদশাহ নামদার
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
রিভিউ :
মরিয়াম মুন্নী
...................................................
হুমায়ূন আহমেদ রচিত "বাদশাহ নামদার" উপন্যাসটি প্রথম
প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। সম্রাট হুমায়ূনের জীবন
কেন্দ্রিক উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা
যেতে পারে। ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা
উপন্যাসই ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইতিহাসের সাথে এর
পার্থক্য হলো ইতিহাসে ঘটিত কাহিনীর বাইরে কিছু
যুক্ত করার সুযোগ নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের
ক্ষেত্রে মূল কাহিনীকে অবিকৃত রেখে গল্পে
গতিশীলতা আনতে লেখক কিছু কাল্পনিক চরিত্র বা
কাহিনী যুক্ত করতে পারেন। "বাদশাহ নামদার" এর
ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করতে গেলে ইতিহাসের গভীর
পাঠ প্রয়োজন। সাধারণ পাঠক হিসেবে বইটার অধিকাংশ
ঘটনাকে সত্য বলে জেনেছি। সেই দৃষ্টিকোণ
থেকে এটাকে 'ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস' বলা
যেতে পারে।
মোঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ূনের জীবনের
গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাস "বাদশাহ নামদার"। পুত্রের
দুরারোগ্য ব্যাধি নিজের শরীরে ধারণ করে
বাবরের মৃত্যুর তিন দিন পরে সিংহাসনে বসেন সম্রাট
হুমায়ূন। ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহের মতো নানা প্রতিকূলতার
মাঝেই চলছিল তার রাজ্য শাসন। ভালোবাসতেন কবিতা,
ছবি আঁকা, গান, জাদুবিদ্যা। রাজনৈতিক কূটনীতির অভাবে
শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে হন রাজ্য হারা।
রাজ্যহারা সম্রাট হামিদা বানু নামে এক কিশোরীর
প্রেমে পড়ে যান। অনেকটা জোর করেই
বিয়ে করেন হামিদা বানুকে। এরপর শত্রুর দ্বারা তাড়িত
হয়ে পথে প্রান্তরে কাটাতে হয় নিদারুণ কষ্টের
জীবন। পারস্য সম্রাটের সহযোগিতা, বিশেষত
সেনাপতি বৈরাম খাঁর দক্ষতাবলে ফিরে পান সাম্রাজ্য।
ফিরে পান পালিয়ে বেড়ানোর সময় ছেড়ে যাওয়া
সন্তান আকবরকে।
ঐতিহাসিক কাহিনীগুলো ইতিহাস সচেতন পাঠকের
অজানা নয়। কিন্তু লেখকের কলমে সেই ষোল
শতকের কাহিনী যেন খোলস ভেঙ্গে নতুন
ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পাঠক মাত্রই যেন
শুনতে পায় আকিকা বেগম নামে ছোট্ট রাজকন্যার
আত্মচিৎকার। বৈরাম খাঁর বিশ্বস্ততা, জওহর আবতাবচির
আনুগত্য শ্রদ্ধাবোনত করে পাঠক মন। শেরশাহের
রাজনৈতিক কূটকৌশল বুঝিয়ে দেয় কত কঠিন ছিল ক্ষমতার
মসনদ টিকিয়ে রাখার লড়াই। প্রথাগত রাজ- দাম্পত্যের
যে চিত্র মানসপটে আঁকা ছিল দীর্ঘ দিন সেটার
বিপরীতে প্রেমময়, সহজ, সুন্দর দাম্পত্যের
ইতিহাস তুলে ধরে হামিদা বানু চরিত্রটি। বিশ্বাসঘাতক
হরিশংকর, ক্ষমতালোভী যুবরাজ কামরান মীর্জা মনে
করিয়ে দেয় ভয়াবহ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথা; মনে
করিয়ে দেয় সম্রাট বাবরের কথা -" সম্রাটের
কোনো পুত্র থাকে না, স্ত্রী থাকে
না,আত্মীয়- পরিজন থাকেনা, সম্রাটের থাকে তরবারি।"
সম্রাট হুমায়ূন যেন ঠিক ছকে বাঁধা মোঘল সম্রাট নন,
একজন খেয়ালী রাজা। একজন বাদশাহ হুমায়ূন, যাকে
তরবারির আঘাতে দেশ জয় করতে হতো,
অপরাধীর বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করতে
হতো, কঠোর হাতে দমন করতে হতো
বিদ্রোহীদের। আবার প্রবল ক্ষমতাধর মানুষটি
ভালোবাসতেন কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, গান
শুনতে। চরম বিপদের মুহূর্তেও প্রকৃতির সৌন্দর্যে
মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন, আওরাতেন স্বরচিত
কোন কবিতা। সন্তানের প্রতি ছিল অপরিসীম স্নেহ,
স্ত্রীর জন্য ভালোবাসা। ক্ষমতার লোভে
ষড়যন্ত্রকারী ভাইকেও ক্ষমা করার মতো ছিল তার
উদারতা। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ভিসতি নিজামকে
একদিনের সম্রাট বানানো প্রমাণ দেয় তার সততার।
রান্নার রেসিপি সংকলনের চিন্তা বা যাদুবিদ্যা নিয়ে তার
অদ্ভুত চিন্তা তুলে ধরে তার খামখেয়ালিপনার প্রমাণ।
আর তাই লেখক হুমায়ূনের কলমে সম্রাট হুমায়ূন কে
ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে 'মানুষ হুমায়ূন'।
চমৎকার প্রচ্ছদটার ধারণা নেয়া হয়েছে মোঘল
আমলের চিত্রকলা থেকে। প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে
সভাসদ ব্যষ্টিত হুমায়ূনের সামনে হুমায়ূন পুত্র
আকবরের 'প্রতিকৃতি' হাতে বসে আছেন হিন্দল
মীর্জা। আকবরের খাৎনা উৎসবে হিন্দল হুমায়ূনকে
প্রতিকৃতিটি উপহার দেন। সেদিনের সেই আনন্দঘন
মুহূর্তটুকু নিজ চিত্রকর্মে ধরে রাখেন দাস্ত মুহাম্মাদ।
মোঘল সম্রাজ্যের এই চিত্রশিল্পী ১৫৪৬ সালে
আঁকেন এই চিত্রটি, যেটা এই বইয়ে প্রচ্ছদ
হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বইয়ে
প্রচ্ছদকারী হিসেবে নাম দেয়া আছে ধ্রুব
এষের। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত চিত্রকর্মের ঐতিহাসিক
গুরুত্বের কোন তথ্য সংযুক্ত করা হয়নি বইটিতে।
ইতিহাসের গুরুগম্ভীর ভাব - ভাষা থেকে বের
হয়েও যে ইতিহাস কেন্দ্রিক কিছু লেখা যায় সেটাই
প্রমাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রচ্ছদ, উৎসর্গ,
বইটি লেখার কারণ নিয়ে লেখা ভূমিকাতেও মুগ্ধতার
রেশ ছড়িয়েছেন লেখক। সুখপাঠ্য উপন্যাসটি
পাঠককে শেষ অবধি আটকে রাখবে বইয়ের পাতায়।
হুমায়ূন আহমেদ যে বইগুলোর জন্য হয়তো
শতাব্দী পরেও স্মরণীয় হবেন এটি সেরকমই
একটি সৃষ্টি বলে মনে করি। এবং খানিকটা আফসোস
হয় কেন এই মেধাবী লেখক আমাদের জন্য
ইতিহাস থেকে আরো কিছু 'হুমায়ূনীয় ভাষায়' লিখে
গেলেন না!
============
Download link or Read online: “বাদশাহ নামদার - হুমায়ুন আহমেদ.pdf”